Monday, August 2, 2010

ফাদার অফ অল রাজাকারস - মাওলানা আবুল কালাম মোহাম্মদ ইউসুফ।


মাওলানা ইউসুফের বাড়ি বাগেরহাটের শরণখোলা উপজেলার রাজৈর গ্রামে। জামায়াতে ইসলামীর মাওলানা আবুল কালাম মোহাম্মদ ইউসুফ একজন কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধী। একাত্তরে তিনিই প্রথম খুলনায় প্রতিষ্ঠা করেন রাজাকার বাহিনী। শান্তি কমিটিরও তিনি ছিলেন খুলনা জেলার আহ্বায়ক। তারই নেতৃত্বে পরিচালিত হতো সেখানকার নয়টি প্রধান নির্যাতন সেল। রাজাকার বাহিনীর ৯৬ ক্যাডার মুক্তিযুদ্ধকালীন নয় মাস সেসব সেলে পাশবিক নির্যাতন চালিয়েছে মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মানুষদের ওপর। সেখান থেকে নিয়ে গিয়ে হত্যা করা হতো শহরের প্রধান চারটি স্থানে।

জামায়াতে ইসলামীর জ্যেষ্ঠ নায়েবে আমির মাওলানা আবুল কালাম মোহাম্মদ ইউসুফ। ১৯৭১ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর দালালি করার দায়ে মুক্তিযুদ্ধের পর দালাল আইনে মাওলানা ইউসুফের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়েছিল।

সংশ্লিষ্ট দলিলপত্রে দেখা যায়, একাত্তর সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সমর্থনে গঠিত ডা. মালেকের মন্ত্রিসভায় বর্তমান জামায়াতে ইসলামীর দুজন সদস্য ছিলেন। এঁদের একজন এই মাওলানা ইউসুফ ছিলেন রাজস্ব মন্ত্রী। অপরজন সাবেক ভারপ্রাপ্ত আমির আব্বাস আলী খান শিক্ষামন্ত্রী ছিলেন। আব্বাস আলী খান বেঁচে নেই। মুক্তিযুদ্ধের পর এঁরা দুজনই গ্রেপ্তার হন। ওই মন্ত্রিসভার এক সদস্য প্রথম আলোকে জানিয়েছেন, স্বাধীনতার পর মাওলানা ইউসুফের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়েছিল। এ বিষয়ে জানতে মাওলানা ইউসুফকে ফোন করা হলে তিনি বলেন, ‘আমি অসুস্থ, কথা বলতে পারব না।’ গত মার্চ মাসে মাওলানা ইউসুফ প্রথম আলোকে বলেছিলেন, গ্রেপ্তার ও বিচারের বিষয়ে কিছুই তাঁর মনে নেই।

মালেক মন্ত্রিসভার সদস্য ও খেলাফত মজলিসের একাংশের আমির মাওলানা মোহাম্মদ ইসহাক প্রথম আলোকে জানিয়েছেন, মুক্তিযুদ্ধের পর তিনিসহ ওই মন্ত্রিসভার সব সদস্য গ্রেপ্তার হন। আদালত তাঁকেও (ইসহাক) যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন। মাওলানা ইসহাক আরও জানান, তাঁর মামলার রায়ের কয়েক দিন আগে জামায়াতের বর্তমান ভারপ্রাপ্ত আমির মাওলানা এ কে এম ইউসুফকেও একই সাজা দেন আদালত। ১৯৭২ সালের ১৭ ডিসেম্বর পত্রপত্রিকায় সে সংবাদ ছাপা হয়। বাংলার বাণী পত্রিকায় ওই সংবাদের শিরোনাম ছিল, ‘দালাল মন্ত্রী ইউসুফের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড’।

মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষক এ এস এম সামছুল আরেফিন প্রথম আলোকে নিশ্চিত করেছেন, জামায়াতের বর্তমান ভারপ্রাপ্ত আমির আবুল কালাম মোহাম্মদ ইউসুফই ওই ব্যক্তি। তিনি এরূপ দণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের একটি তালিকা করেছেন। তিনি জানান, মালেক মন্ত্রিসভার সব সদস্যেরই মুক্তিযুদ্ধের পর যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়েছিল। ১৯৭১ সালের ১২ আগস্ট মালেক মন্ত্রিসভায় যোগ দেওয়ার আগপর্যন্ত তৎকালীন জামায়াতের অন্য শীর্ষস্থানীয় নেতাদের পাশাপাশি মাওলানা ইউসুফও রাজাকার বাহিনী গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তিনি একাত্তর সালের মে মাসে খুলনার খানজাহান আলী সড়কের একটি আনসার ক্যাম্পে ৯৬ জন জামায়াত কর্মী নিয়ে প্রথম রাজাকার বাহিনী গঠন করেন। জামায়াতের দলীয় মুখপত্র দৈনিক সংগ্রামসহ সে সময়ের সব সংবাদপত্রে এ খবর ছাপা হয়।

গবেষক এ এস এম সামছুল আরেফিনের মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে ব্যক্তির অবস্থান বইয়ে (ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড থেকে ১৯৯৫ সালে প্রকাশিত ও ১৯৯৮ সালে পুনর্মুদ্রিত) এ কে এম ইউসুফকে রাজাকার বাহিনীর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে (পৃ-৪২২)। ১৯৭১ সালের ২২ সেপ্টেম্বর আব্বাস আলী খান ও মাওলানা ইউসুফসহ মালেক মন্ত্রিসভার কয়েকজন সদস্যকে ঢাকা আলিয়া মাদ্রাসার ছাত্র ও শিক্ষকেরা সংবর্ধনা দেন। পরদিন দৈনিক সংগ্রাম পত্রিকায় তা নিয়ে যে সংবাদ প্রকাশ হয় তাতে দেখা যায়, ওই অনুষ্ঠানে মাওলানা ইউসুফ বলেছিলেন, ‘যুব সমাজকে পাকিস্তান সৃষ্টির মূল লক্ষ্য সম্পর্কে অবহিত করা হয়নি বলেই তারা আজ নিজেদের পাকিস্তানী ও মুসলমান পরিচয় দিতে লজ্জা বোধ করে।’

একাত্তর সালের ২৫ সেপ্টেম্বরের সংগ্রাম-এর প্রথম পাতায় তেজগাঁও থানা শান্তি কমিটি মালেক মন্ত্রিসভার সদস্যদের সংবর্ধনা দিয়েছে বলে খবর প্রকাশিত হয়। ওই খবরে দেখা যায়, এ কে এম ইউসুফ তাঁর বক্তব্যে বলেন, পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকেই ইসলামের দুশমনরা এর অস্তিত্ব ধ্বংস করার ষড়যন্ত্র চালিয়ে আসছে এবং বিভিন্ন পন্থায় তারা এই ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তার করেছে। মার্চ মাসের ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপকেও ইউসুফ এই ষড়যন্ত্রের পরিণাম বলে উল্লেখ করেন।

একাত্তর সালের ১৮ অক্টোবর সংগ্রাম-এ প্রকাশিত আরেকটি প্রতিবেদনে দেখা যায়, মালেক মন্ত্রিসভার সদস্য (রাজস্ব মন্ত্রী ইউসুফ) হিসেবে তিনি বলেন, দেশের সার্বভৌমত্বের ওপর হামলার যেকোনো অপচেষ্টা নস্যাৎ করে দেওয়ার জন্য সেনাবাহিনী ও রাজাকারদের পেছনে আমাদের সাহসী জনগণ ঐক্যবদ্ধ থাকবেন।’

২৮ নভেম্বর করাচিতে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলোচনাকালে মাওলানা ইউসুফ বলেছিলেন, ‘রাজাকাররা আমাদের বীর সেনাবাহিনীর সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ভারতীয় হামলার মোকাবিলা করছে।’ তিনি রাজাকারদের হাতে আরও আধুনিক অস্ত্র দেওয়ার দাবি জানান। পরদিন ২৯ নভেম্বর দৈনিক সংগ্রাম পত্রিকায় এ সংবাদ প্রকাশ হয়।

তথ্য সূত্র: প্রথম আলো, ২২ মে ২০০৮

জামায়াত নেতার বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধ মামলা - বাগেরহাট, জানুয়ারি ০৪ (বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম) - জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় কমিটির সিনিয়র নায়েবে আমির মাওলানা আবুল কালাম মো. ইউসুফের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধের সময় হত্যা, লুটপাট ও বসতবাড়িতে অগ্নিসংযোগের অভিযোগে বাগেরহাটের একটি আদালতে মামলা হয়েছে।

মাওলানা ইউসুফের বাড়ি বাগেরহাটের শরণখোলা উপজেলার রাজৈর গ্রামে। মামলায় জামায়াত নেতা ছাড়াও বিএনপির সাবেক সাংসদসহ ৩৫ জনকে আসামি করা হয়েছে। সোমবার দুপুরে জেলার অতিরিক্ত মুখ্য বিচারিক হাকিমের আদালতে মামলাটি করেন শরণখোলা উপজেলার দক্ষিণ রাজাপুর গ্রামের খাদিজা বেগম। হাকিম আব্দুস সালাম খান অভিযোগটি এজাহার হিসাবে নথিভুক্ত করার জন্য শরণখোলা থানার ওসিকে নির্দেশ দিয়েছেন।

মামলার অপর আসামিরা হলেন- মোরেলগঞ্জ উপজেলা বিএনপির সভাপতি ও সাবেক সাংসদ মিঞা আব্বাস উদ্দিন, শরণখোলা উপজেলার খাদা গ্রামের মতিয়ার রহমান মতি, পশ্চিম খাদার আব্দুল হামিদ ফরাজী, রায়েন্দা বাজারের লতিফ পঞ্চায়েত, আবুল হারেজ খান, লুৎফর রহমান, আব্দুল হক আকন, ওহাব খান, গোলবুনিয়ার দুই সহোদর ইদ্রিস মোল্লা ও হাবিব মোল্লা, একই গ্রামের আবুল কালাম আজাদ, মালিয়া রাজাপুরের তোফাজ্জেল হোসেন, কদমতলার দুই সহোদর সুলতান মৃধা ও নূর উদ্দিন মৃধা, খোন্তাকাটা গ্রামের আমির হোসেন মুন্সী, আব্দুর রব গাজী, আমির হোসেন, ইব্রাহিম, জিলবুনিয়ার সুলতান আহমেদ, আমড়াগাছিয়ার আলতাফ আলী, মঠের পাড়ের হাবিব আকন, রাজৈরের মোতালেব কবিরাজ, কালিয়ার খাল এলাকার মজিদ তালুকদার, বানিয়াখালীর সোলায়মান আকন, পশ্চিম বানিয়াখালীর আব্দুল হামিদ খান, দক্ষিণ খোন্তাকাটার নুহু ফরাজী, আমির আলী মীর, মালিয়ার দেলোয়ার হোসেন, তাফালবাড়ি বাজারের সেকেন্দার হাওলাদার, উত্তর তাফালবাড়ির আব্দুর রউফ হাওলাদার, হামেছ পাহলোয়ান, খুড়িয়াখালীর মোসলেম আকন, বকুলতলার আব্দুল কাদের চৌকিদার, নজির মৃধা ও খুলনা সিটি করপোরেশনের ক্লে রোড এলাকার আবুল বাশার।

এজাহারে বলা হয়, মাওলানা ইউসুফ ও মিঞা আব্বাস উদ্দিনের নেতৃত্বে আসামিরা ১৯৭১ সালে শরণখোলা উপজেলার রায়েন্দা বাজার নতুন থানা বিল্ডিং এর দোতালায় ক্যাম্প করে মুক্তিযোদ্ধাসহ সাধারণ মানুষকে হত্যা ও লুটপাট করে। ওই বছর ৭ জুন সকালে বাদীর স্বামী ইসমাঈল হোসেন হাওলাদার ও খুড়িয়াখালী গ্রামের আসমত মুন্সীসহ একদল মুক্তিযোদ্ধা রাজাকার ক্যাম্পে হামলা চালালে উভয়পক্ষে তুমূল গুলি বিনিময় হয়।

এক পর্যায়ে মুক্তিবাহিনীর গুলি ফুরিয়ে গেলে ইসমাঈল হোসেন ও আসমত মুন্সী রাজাকারদের হাতে ধরা পড়েন। পরে আসামিরা তাদের পিটিয়ে ও ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে এবং জবাই করে লাশ রায়েন্দা খালে ফেলে দেয়। দুই তিনদিন পর ইসমাঈলের লাশ উদ্ধার করা গেলেও আসমতের লাশ পাওয়া যায়নি।

পরদিন বিকালে আসামিরা বাদীর বসতবাড়িতে হামলা চালিয়ে ধান, নগদ টাকা, স্বর্ণালঙ্কারসহ মূল্যবান জিনিসপত্র লুট করে বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়।

শরণখোলা থানার ওসি নিজাম উদ্দিন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, এ ধরনের কোনো মামলা এখনো তার হাতে এসে পৌঁছায়নি। পেলে আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে তিনি জানান।

বাগেরহাটের মুক্তিযোদ্ধা শেখ কামরুজ্জামান টুকু বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, মাওলানা ইউসুফ ১৯৭১ সালে পূর্ব পাকিস্তান সরকারের শিক্ষামন্ত্রী ছিলেন। এছাড়া তিনি পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর দোসর রাজাকার বাহিনীর খুলনা অঞ্চলের সংগঠক ছিলেন।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম/প্রতিনিধি/এমএসবি/১৮২১ ঘ.